নিউমোনিয়াঃ Pneumonia
শিশুদের শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ অত্যন্ত বেশী হয় এবং এ রােগে শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশী (প্রায় ২০-২৫%)। নাক থেকে ফুসফুস পর্যন্ত যে কোন সংক্রমণকেই শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ (এআরআই) বলা হয়, আর শুধুমাত্র ফুসফুসের সংক্রমনকে নিউমােনিয়া বলে।
বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস ফুসফুসে প্রবেশ করে নিউমােনিয়া রােগের সৃষ্টি করে। আমরা জানি ফুসফুস হচ্ছে মৌচাকের মতাে ছােট ছােট ফাপা এলভিওলাসের সমষ্টি। এগুলাে স্পঞ্জের মতাে নরম ও স্থিতিস্থাপক। নিউমােনিয়া বা ফুসফুসের সংক্রমণ হলে ফুসফুসের এই এলভিওলাস গুলাে স্পঞ্জের মতাে আর নরম থাকে না।
যকৃত বা কলিজার মতাে শক্ত হয়ে যায়। ফলে শ্বাস প্রশ্বাসের সময় সংকোচন ও প্রসারণে বাধা পায় এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
সব বয়সের মানুষেরই নিউমােনিয়া হতেপারে। তবে শিশুদের বেলায় নিউমােনিয়া বেশী হয়। সময়মতাে সঠিক চিকিৎসা করা না গেলে এ রােগে শিশুর মৃত্যুর সম্ভাবনা খুব বেশী থাকে।
কারণঃ Cause
ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া (নিউমােকক্কাস, স্টেফাইলােকক্কাস, স্ট্রেপটোকক্কাস, ক্লেবশিয়েলা ইত্যাদি) দ্বারা সংক্রমণের ফলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নিউমােনিয়া হয়।
ঝুঁকিপূর্ণ উপাদানঃ Risk Factor
- কম ওজনের শিশুর জন্মগ্রহণ (জন্মকালীন ওজন ২-১/২ কেজির কম)
- সঠিকভাবে বুকের দুধ না খাওয়ানাে
- অপুষ্টি
- ৬ টি রােগের প্রতিষেধক টিকা না দেয়া
- ভিটামিন – এ’র অভাব # ঠান্ডা স্যাতসঁতে পরিবেশ
- ঘনবসতি ও দূষিত পরিবেশ
- বিড়ি, সিগারেট, কলকারখানা বা রান্নার ধােয়া।
উপসর্গঃ Symptom
- এই রােগের প্রধান উপসর্গ হচ্ছে কাশি, বমি, শ্বাসকষ্ট ও জ্বর।
- শিশুদের বেলায় জ্বরের সাথে খিচুনি হতে পারে।
- জ্বরের সঙ্গে শরীর ম্যাজম্যাজ, ক্ষুধামন্দা,অবসন্নভাব ইত্যাদি উপসর্গও থাকতে পারে।
- রােগের প্রথম দিকে বুকে সামান্য ব্যথা হতে পারে, এবং কাশির সাথে বুকের ব্যথা বেড়ে যায়।
- রােগীর শ্বাস – প্রশ্বাস স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি পূর্ণ বয়স্কদের মিনিটে ১২-১৮ বার এবং শিশুদের ক্ষেত্রে ২৫-৪০ বার। এক বছরের কম বয়সের শিশুর শ্বাসের গতি মিনিটে ৫০ বারের বেশী এবং এক বছরের বেশী বয়সের শিশুর শ্বাসের গতি মিনিটে ৪০ বারের বেশী হলে মারাত্নক নিউমােনিয়া হয়েছে বুঝতে হবে।
- রােগীর নাড়ীর গতিও সাথে সাথে বেড়ে যায়। রােগীর বেশ শ্বাসকষ্ট হয় এবং শ্বাস প্রশ্বাসের সময় নাকের পাতা উঠানামা করে।
- এ ছাড়াও রােগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে ঘড়ঘড় শব্দ শােনা যায়।
- রােগটি মারাত্নক হলে শরীরে অক্সিজেনের অভাবে চামড়া নীল হয়ে যায়। তাই নিউমােনিয়া চিকিৎসায় এক্ষেত্রে রােগীকে অক্সিজেন দিতে হয়। এ সময় অক্সিজেন দেয়া না গেলে রােগী মারা যেতে পারে।
শ্রেণী বিন্যাসঃ Classification
চিকিৎসা দেবার জন্য নিউমােনিয়া (এ, আর, আই) রােগকে শিশুর বয়স অনুযায়ী যে ভাবে শ্রেণী বিন্যাস করা হয়ঃ
শিশুর বয়স ০ – ২ মাসঃ
- খুব মারাত্বক রােগ
- মারাত্নক নিউমােনিয়া
- নিউমােনিয়া নয় (কাশি অথবা যদি)
শিশুর বয়স ২ মাস – ৫ বৎসরঃ
- খুব মারাত্নক রােগ।
- মারাত্নক নিউমােনিয়া
- সাধারণ নিউমােনিয়া
- নিউমােনিয়া নয় (কাশি অথবা সর্দি) ‘
০-২ মাস বয়সের শিব্র শ্রেণী বিভাগ অনুযায়ী রােগের লক্ষণঃ
১। খুব মারাত্নক রােগঃ Very Severe Disease
লক্ষণ ও উপসর্গঃ Symptom & Sign
- ভালােভাবে না খাওয়া (অসুস্থ অবস্থায় পরিমাণে স্বাভাবিক খাবারের অর্ধেকের চেয়ে কম খাওয়া)
- খিচুনী
- অস্বাভাবিক ঘুম ঘুম ভাব বা সহজে জাগানাে যায় না
- শ্বাস-প্রশ্বাসে শাঁই শাঁই শব্দ
- জ্বর অথবা শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কম।
উপরের যে কোন ১টি লক্ষণ থাকলেই বুঝতে হবে শিশুটি খুব মারাত্বক রোগে আক্রান্ত।
২। মারাত্নক নিউমােনিয়াঃ Severe Pneumonia
লক্ষণ ও উপসর্গঃ Symptom & Sign
- খুব মারাত্নক রােগের লক্ষণ নাই (পূর্বে বর্ণিত)
- কিন্তু শ্বাস নেবার সময় শিশুর বুক যদি মারাত্বকভাবে চেপে যায় (বুকের নীচের অংশ) অথবা দ্রুত শ্বাস (শ্বাস প্রশ্বাসের গতি মিনিটে ৬০ বার বা তার বেশী) থাকে তাহলে বুঝতে হবে শিশুটি মারাত্নক নিউমােনিয়ায় আক্রান্ত।
বিঃ দ্রঃ ছােট শিশুদের বুকের পাঁজরের হাড় নরম থাকায় সুস্থ অবস্থায় কিছু বুক চেপে যাওয়া থাকতে
পারে – এটা অসুখের লক্ষণ নয়।
৩। নিউমােনিয়া নয়ঃ কাশি অথবা সর্দিঃ No Pneumonia: Cough or Cold
লক্ষণ ও উপসর্গঃ Symptom & Sign
- খুব মারাত্নক রােগের লক্ষণ বা চিহ্ন নাই (পূর্বে বর্ণিত)।
- মারাত্নক নিউমােনিয়ার লক্ষণ/চিহ্ন নাই (পূর্বে বর্ণিত)।
- কিন্তু শিশুর যদি কাশি বা সর্দি অথবা উভয়েই, জ্বর (থাকতে পারে) তাহলে বুঝতে হবে শিশুটি নিউমােনিয়া নয় সাধারণ কাশি অথবা সর্দিতে আক্রান্ত। প্রথমে খুব মারাত্নক রােগের লক্ষণ খুঁজতে হবে, না পেলে মারাত্নক নিউমােনিয়ার লক্ষণ (উপরের দুটি) না পেলে নিউমােনিয়া নয়ঃ সাধারণ কাশি বা সর্দি বলে ধরে নিতে হবে।
০২ মাস- ০৫ বৎসর বয়সের শিশু শ্রেণী বিভাগ অনুযায়ী রােগের লক্ষণঃ
১। খুব মারাত্নক রােগঃ Very Severe Disease
লক্ষণ ও উপসর্গঃ Symptom & Sign
- পানীয় গ্রহনে অপারগতা (তরল জাতীয় খাবার খেতে না পারা বা প্রতিবার খাবারের পর সাথে সাথে বমি করা), খিচুনী থাকতে পারে।
- অস্বাভাবিক ঘুম ঘুম ভাব বা সহজে জাগানাে যায় না
- (শান্ত অবস্থায়) শ্বাস নেবার সময় বাধাগ্রস্থ হবার শব্দ- স্ট্রাইডর
- মারাত্নক পুষ্টিহীনতা
উপরের যে কোন ১টি লক্ষণ থাকলেই বুঝতে হবে শিশুটি খুব মারাত্নক রােগে আক্রান্ত।
২। মারাত্নক নিউমােনিয়াঃ Severe Pneumonia
লক্ষণ ও উপসর্গঃ Symptom & Sign
- খুব মারাত্নক রােগের লক্ষণ নাই (পূর্বে বর্ণিত)
- কিন্তু শ্বাস নেবার সময় বুকের নিচের অংশ ভেতরের দিকে চেপে গেলে (Chest Indrawing) বুঝতে হবে শিশুটি মারাত্নক নিউমােনিয়ায় আক্রান্ত।
৩। সাধারণ নিউমােনিয়াঃ Pneumonia
- খুব মারাত্নক রােগের লক্ষণ নাই (পূর্বে বর্ণিত)
- মারাত্নক নিউমােনিয়ার লক্ষণ বা বুক চেপে যাওয়া নাই (পূর্বে বর্ণিত)
- কিন্তু দ্রুত শ্বাস থাকলে বুঝতে হবে শিশুটি সাধারণ নিউমােনিয়ায় আক্রান্ত।
দ্রুত শ্বসঃ
২ মাস থেকে ১ বৎসরঃ প্রতি মিনিটে ৫০ বার বা তার বেশি
১ বৎসর থেকে ৫ বৎসরঃ প্রতি মিনিটে ৪০ বার বা তার বেশি
৪। নিউমােনিয়া নয়ঃ কাশি অথবা সর্দিঃ No Pneumonia Cough or Cold
- খুব মারাত্নক রােগের কোন লক্ষণ নাই (পূর্বে বর্ণিত)
- মারাত্নক নিউমােনিয়ার লক্ষণ বা বুক চেপে যাওয়া নাই (পূর্বে বর্ণিত)
- সাধারণ নিউমােনিয়ার লক্ষণ বা দ্রুত শ্বাস নাই (পূর্বে বর্ণিত)
- কিন্তু শিশুর যদি কাশি বা সর্দি অথবা উভয়েই, জ্বর (থাকতে পারে) থাকে তাহলে বুঝতে হবে শিশুটি নিউমােনিয়া নয়ঃ কাশি অথবা সর্দিতে আক্রান্ত।
- প্রথমে খুব মারাত্মক রােগের লক্ষণ খুঁজতে হবে, না পেলে মারাত্নক নিউমােনিয়ার লক্ষণ, তা না পেলে সাধারণ নিউমােনিয়ার লক্ষণ, কোনটা (উপরের ৩টি) না পেলে নিউমােনিয়া নয়ঃ কাশি অথবা সর্দি বলে ধরে নিতে হবে।
চিকিৎসাঃ Treatment
দ্রুত রােগ নির্ণয় ও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিউমােনিয়া (এ, আর, আই) আক্রান্ত শিশুর জীবন রক্ষা করা সম্ভব।
১। খুব মারাত্নক রােগ অথবা মারাত্নক নিউমােনিয়া
- রােগীকে জরুরী ভিত্তিতে নিকটতম হাসপাতালে প্রেরণ করতে হবে।
- হাসপাতালে প্রেরণের সময় ১ম ডােজ এন্টিবায়ােটিক (কেট্রোইমক্সাজল/এমােক্সিসিলিন/
সেফ্রাডিন ইত্যাদি) দিতে হবে।
১ম ডােজ এন্টিবায়ােটিক কোন ক্ষেত্রে দেয়া যাবে না
- শিশু কিছু ঢােক গিলে খেতে না পারলে
- শিশু অজ্ঞান অবস্থায় থাকলে ও জন্ডিসে আক্রান্ত হলে
- শিশুর ওজন আড়াই কেজির কম হলে
২। সাধারণ নিউমােনিয়া- Pneumonia
- শিশুকে এন্টিবায়ােটিক দিতে হবে বয়স অনুযায়ী
- এন্টিবায়ােটিক গ্রহণরত শিশুকে ২ দিনের মধ্যে পুনরায় পরীক্ষার জন্য আসতে হবে
- বাড়ীতে যত্ন নেবার জন্য মাকে পরামর্শ দিতে হবে
- জ্বর থাকলে জ্বরের চিকিৎসা দিতে হবে।
জন্ডিসে আক্রান্ত শিশুকে কোট্রাইমক্সাজল দেয়া যাবে না। চিকিৎসার জন্য দ্রুত হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে হবে। এছাড়া বাড়ীতে যত্ন নেয়ার জন্য মাকে পরামর্শ এবং জ্বরের চিকিৎসা দিতে হবে।
৩। নিউমােনিয়া নয়ঃ কাশি অথবা সর্দিঃ No Pneumonia ও Cough or Cold
- কোন ঔষধের প্রয়ােজন নাই
- শুধু মাত্র বাড়ীতে শিশুর যত্ন নেয়ার জন্য মাকে পরামর্শ দিতে হবে।
- জ্বর থাকলে জ্বরের চিকিত্সা করতে হবে ,
- কাশি একটানা ৩০ দিনের বেশি হলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে হবে। ২ মাস থেকে ৫ বৎসর বয়সের শিশুর বাড়ীতে যত্ন নেয়ার জন্য মাকে পরামর্শ দিতে হবে।
নীচের লক্ষণগুলি মাকে খেয়াল রাখতে বলতে হবে এবং যে কোন একটি লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্র দ্রুত শিশুকে নিয়ে আসতে বলতে হবেঃ
- শ্বাস কষ্ট
- দ্রুতশ্বাস
- খাওয়ার সমস্যা দেখা দিলে
- শিশু ক্রমশঃ আরাে অসুস্থ হয়ে পড়লে
- জ্বর ছােট শিশুর মারাত্মক রােগের লক্ষণ। তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে হবে।
- অল্প জ্বরে প্যারাসিটামল দেয়া যাবে না।
- অধিক জ্বরে প্যারাসিটামল দেয়া যাবে না।
- অধিক জ্বর হলে মাথায় পানি দিতে হবে। গা-হাত-পা ভিজা কাপড় দিয়ে মুছে দিতে হবে
- জরএকটানা ৫ দিনের বেশী হলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে হবে।
- জ্বর: বগলে ১০১ ডিগ্রী ফারেনহাইটের উপরে হলে প্যারাসিটামল দিতে হবে
- মাকে যা যা পরামর্শ দেয়া হলাে তা ভালাে ভাবে বুঝতে পারলেন কিনা মা’র কাছ থেকে তা জেনে নিতে হবে।